শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:১২ অপরাহ্ন
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি, কালের খবর : বৃহত্তর কুষ্টিয়ার জনসাধারণের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের অন্যতম কেন্দ্র ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল।বিপুল জনসংখ্যার জন্য একমাত্র এ হাসপাতালটি নিজেই নানা অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত।কিছু চিকিৎসকের দায়িত্বে অবহেলায় ক্রমাগত রোগী মৃত্যু,টেস্ট বানিজ্য,বহিঃবিভাগে চিকিৎসার পরিবর্তে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারের ভিজিটিং কার্ড প্রদান,প্রভাবশালী পরিচয় ছাড়া চিকিৎসা না পাওয়া,কিছু নার্স,স্টাফদের দায়িত্বে অবহেলা ও রোগীর সাথে দুর্ব্যবহার,২৪ ঘন্টা সেবাদানকারী ব্লাড ব্যাংকের দরজা মধ্য রাত হলেই বন্ধ,বিশুদ্ধ পানির একমাত্র ফিল্টারটি অকেজো, হাসপাতাল অপরিষ্কার,দুর্গন্ধ,অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ,দালালের চরম দৌরাত্ম,তত্বাবধায়কের বদলি আদেশের মাস ছুলেও কর্মস্থল না ছাড়ার মতো গুরুতর বিস্তর অভিযোগ।
গত ০৬ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) রাত সাড়ে ৯ টার দিকে অসুস্থ মা’কে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে যায় দৈনিক আন্দোলনের বাজার পত্রিকার সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার অর্পণ মাহমুদ। জরুরি বিভাগের গেটের মুখে অসুস্থ মা’কে রেখে ভেতরে স্ট্রেচার আনতে যায়। স্ট্রেচার না পেয়ে সেদিনের কর্তব্যরত চিকিৎসক ইকবাল হাসান শোভনকে বাইরে এসে তাঁর মাকে দেখার জন্য অনুরোধ করেন। এদিকে মায়ের শারিরীক পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হতে থাকলে তিনি আবার ওই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে কাকুতিমিনতি করেন।ওই চিকিৎসক না এসে বরং উল্টো তাঁকেই (অর্পণ) বেফাঁস ভাষায় গালিগালাজ করে। এভাবে প্রায় আধাঘন্টা অতিক্রান্ত হলে শেষমেশ ওই সাংবাদিক মা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে! এ খবর ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতালে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীরা হাসপাতালে আসে।তখন ওই চিকিৎসক দায় এড়াতে মরদেহ নিয়ে চিকিৎসার নাটক শুরু করে। এছাড়াও উন্মে কুলসুম নামে এক মহিলা ব্যক্তি ২৭ নভেম্বর ২০২২ সকাল ৯ টার দিকে এ্যাজমাজনিত সমস্যায় জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে চিকিৎসকের অবহেলায় যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন।এরকম আরও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে চিকিৎসকের অবহেলায় যথাযথ চিকিৎসা না মৃত্যুবরণ করেন বলে জানা যায়।
হাসপাতালে সেবাপ্রত্যাশী ব্যক্তিরা জানান, হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক রোগীর কথা শোনার আগেই কাগজ ভরে টেস্ট লিখে দিয়ে বলেন কমফোর্টে যান,ডলফিনে যান,ওমুক ডায়াগনস্টিকে যান।তাদের মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে টেস্ট না করিয়ে আনলে বলে আবার করিয়ে আনেন।কখনো কখনো ওয়ার্ডের ভেতরেই চিকিৎসকের পেছনে পেছনে ডায়াগনস্টিকের প্রতিনিধি ও দালালদের দেখা যায়। তারা ডাক্তারের মনোনীত ডায়াগনস্টিকে না গেলে রিপোর্ট দেখা হবে না বলে রীতিমতো হুমকি দিতে থাকে।আরও কিছু চিকিৎসক আছে যারা তাদের ভিজিটিং কার্ড রোগীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন এখান থেকে রোগ ভালো হবে না।আমার ব্যক্তিগত চেম্বারে এই ঠিকানায় আসেন।তাছাড়া প্রভাবশালী নেতা,প্রশাসনের কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী কোনো পরিচয় না দিলে হাসপাতালে সুচিকিৎসা মেলে না।হাসপাতালের কিছু নার্স ও স্টাফরা কর্তব্যে চরম অবহেলা এবং অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেন।তাঁরা অলস বসে মোবাইল টিপাটিপি,ফোনালাপ ও খোশগল্প করেন।রাতে কর্তব্যরত কেউ কেউ রুমের দরজা বন্ধ করে ঘুমায়।রোগীর প্রয়োজনে ডাকলেই তারা রোগী ও তাঁদের স্বজনদের সাথে ঝাঁঝাল ও মারমুখী আচরণ করেন।
জরুরি সেবার আওতাধীন হাসপাতালের একমাত্র ব্লাড ব্যাংকটি ২৪ ঘন্টা নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও মধ্য রাত হলেই তার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বর রাত ১ টার দিকে প্রসববেদনা কাতর স্ত্রী লাবনীকে হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে ভর্তি করান স্বামী নাজমুল শেখ। কর্তব্যরত নার্স লাবণীর রক্তের গ্রুপ ও ক্রসম্যাচিং পরীক্ষার জন্য রক্ত ও কাগজ দিয়ে পাঠান ব্লাড ব্যাংকে।তিনি গিয়ে দেখেন ব্লাড ব্যাংকের দরজা,জানালা, ভেতরের বাতি সব বন্ধ। পরে তাঁর মামা গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লে কর্তব্যরত কর্মচারী বিছানা ছেড়ে উঠে বাতি জ্বালিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। জানালার সামনে গিয়ে বন্ধ থাকার কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি রেগে অগ্নিমুর্তি হয়ে যায় এবং নানান কথা শোনাতে থাকেন।এছাড়াও বর্তমানে হাসপাতালের একমাত্র বিশুদ্ধ পানির ফিল্টারটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে।এতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বিশুদ্ধ পানির হাহাকার চলছে। তাছাড়া উপায়ান্তর না পেয়ে হাসপাতালের আশেপাশের অবিশুদ্ধ পানি পান করে অনেকেই পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে চরম অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর। বারান্দা অপরিষ্কার, বাথরুমগুলোতে প্রবেশ করায় যায় না।কোন বাথরুমে মল উপচে পড়ে আছে।তার উপরে মশা মাছি ভোঁ ভোঁ করছে।চরম দুর্গন্ধ!কোন বাথরুমে পানি নেই,বদনা নেই,বাতি নেই।এতোসব সমস্যার উপর আবার রয়েছে দালালের দৌরাত্ম্য। এ হাসপাতালে চিকিৎসক ও রোগী আসার পূর্বেই আসে দালাল। তারা টিকিট ব্লাকিং সহ গ্রামের সহজ সরল রোগীদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিভিন্ন মানহীন ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন টেস্ট ও অপারেশন করিয়ে লুফে নেয় মোটা অংকের কমিশন।এরসাথে জড়িত রয়েছে ওই হাসপাতালেরই বেশ কয়েকজন চিকিৎসক।
হাসপাতালের এতোসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে বিভিন্ন জাতীয় ও কুষ্টিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও তত্ত্বাবধায়ক বা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বরং ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের প্রধান কর্তা ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আব্দুল মোমেন(৪৩৫৯২) নিজেই সরকারি প্রজ্ঞাপনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেয়ার চেপে বসে আছেন। বদলি আদেশের মাস পূর্ণ হতে চললেও চেয়ার ছাড়েননি তিনি। মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের পার-২ অধিশাখার যুগ্ম-সচিব জাকিয়া পারভীন স্বাক্ষরিত ২২ নভেম্বর ২০২২ তারিখের এক প্রজ্ঞাপনে (স্মারক নং-৪৫.০০.০০০০.১৪৮.১৯.০১৪.২১-৬৮৩) কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আব্দুল মোমেনকে ঝিনাইদহ ম্যাটসে বদলির আদেশ করা হয়। জনস্বার্থে জারিকৃত ওই বদলি আদেশ অবিলম্বে কার্যকরের নির্দেশনা থাকলেও এখন পর্যন্ত ওই কর্মকর্তা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের চেয়ারে। কোন অদৃশ্য কারণে তিনি এ চেয়ার ছাড়তে চাচ্ছেন না এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন। এছাড়াও জানা যায় ,তিনি এ বদলি আদেশ পরিবর্তনের জন্য উপর মহলে কৌশলে পুরোদস্তুর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।এজন্য তিনি মোটা অংকের ঘুষ দিতেও প্রস্তুত বলে শোনা যাচ্ছে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসার হালহকিকত ও অপব্যস্থাপনা নিয়ে কুষ্টিয়ার প্রখ্যাত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মীর সাইফুল ইসলাম তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে লেখেন,”মাঝরাতে আপনার আপনজন অসুস্থ হলেই বুঝতে পারবেন কুষ্টিয়া কতটা উন্নত হয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি কোথাও কোনো চিকিৎসা নাই।”তার মন্তব্যের ঘরে নূর আলম নামে এক ব্যক্তি এবিষয়ে লেখেন, “কাঁধে হাত রেখে বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকেছিলাম। ৩ ঘন্টা পরে বাবাকে কাঁধে নিয়ে বের হতে হয়েছে।আর কিছু বলার নাই।” এম জামসেদুল হক জুয়েল লেখেন,”সমস্যা একটাই ডাক্তার যখন নেতা বনে যায়। ডিউটি ঠিকমতো করে না।শুধু কয়েকজনকে পারিবারিক সেবা দেয়। প্রতিবাদ করলে সর্বোচ্চা জায়গায় ফোন দেয়। এজন্য আর কেউ প্রতিবাদ করে না উল্টে ঝামেলায় পড়ার ভয়ে।”ফারজানা ইয়াসমিন লেখেন, “সেবিকাদের ব্যবহার এতো খারাপ বলার বাইরে।পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কথা কি বলবো?মনে হয় ওনারা ডাক্তারের উপরে।”এ্যাড, সাইফুর রহমান সুমন লেখেন,”ডাক্তাররা এখন নাগরিক কমিটিতে যোগ দিয়েছে।হাসপাতালে সেবা কিভাবে দিবে?তারা এখন টাওয়ার তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।”
এছাড়াও শত শত সেবাপ্রত্যাশী, ভুক্তভোগী ও সচেতন ব্যক্তিবর্গ হাসপাতালের সেবা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি তুলে ধরে নেতিবাচক মন্তব্য করেন।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আব্দুল মোমেনকে মুঠোফোনে বদলির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি সময়সীমার মধ্যেই আছি।অবিলম্বে অর্থ ৩ মাস।”এছাড়াও অন্যন্য অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় জানতে চাইলে তিনি যা যা অনিয়ম-দুর্নীতি আছে সব পত্রিকায় ছেপে দেন বলে কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ফোন কেটে দেন।